কার্বন ইস্পাত (Carbon steel)

কেবলমাত্র কার্বন ও লোহার মিশ্রণে কার্বন ইস্পাত তৈরি হয়। কার্বন ইস্পাতে সাধারণত ০.০৫-১.৫% কার্বন থাকে।


কার্বন ইস্পাতের প্রকারভেদ 

 কার্বন ইস্পাত তিন প্রকার।

(১) মাইন্ড স্টিল বা লো কার্বন ইস্পাত (কার্বনের পরিমাণ ০.০৫-০.৩৫%)।

(২) মিডিয়াম কার্বন ইস্পাত (কার্বনের পরিমাণ ০.৩৫-০.৫%)।

(৩) হাই কার্বন ইস্পাত (কার্বনের পরিমাণ ০.৫-১.৫%)।

(৪) টুল ইস্পাত (কার্বনের পরিমান- ১.৫%)


বিভিন্ন প্রকার ইস্পাতে কার্বনের পরিমাণ 

লো-কার্বন ইস্পাত ০.০৫-০.১৫% কার্বন মিশ্রিত ইস্পাতকে ডেড-মাইল্ড ইস্পাত বলে। লো-কার্বন ইস্পাতকে মাইন্ড স্টিলও বলে। সাধারণত রিভেট, স্কু, প্রেস সিট, পাইপ, পেরেক, চেইন, প্লেট বা থালা এবং অটোমোবাইল বডির সিট, অটোফ্রেম, আই বীম ইত্যাদি তৈরি করতে লো-কার্বন ইস্পাত ব্যবহৃত হয়।

মাইন্ড স্টিলকে বা লো কার্বন ইস্পাতকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

 ডেড মাইন্ড স্টিল (Dead mild steel): ০.১% ভাগ পর্যন্ত কার্বন।

 মাইন্ড স্টিল (Mild steel): ০.২৫% ভাগ পর্যন্ত কার্বন।

 স্ট্রাকচারাল স্টিল (Structural steel): ০.৩৫% পর্যন্ত কার্বন।


কার্বন ইস্পাতের ব্যবহার

মিডিয়াম কার্বন ইস্পাত এর ব্যবহার

প্রধানত মিডিয়াম কার্বন ইস্পাত শ্যাফ্ট, এক্সেল, বোল্ট, কানেক্টিং রড, চাবি, গিয়ার, হালকা স্প্রিং, সিলিন্ডার, ক্যাম, নাট-বোল্ট, কাপলিং, ক্র্যাংক শ্যাফট, পিনিয়ন, ইঞ্জিনের ভালভ, স্ত্রীং, টারবাইন, বাকেট হুইল, স্টিয়ারিং আর্ম প্রভৃতি তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়।


হাই কার্বন ইস্পাতের ব্যবহার

অনেক কাজে হাই কার্বন ইস্পাত ব্যবহৃত হয়। ক্র্যাংক শ্যাফট, ব্লেড, অটোমোবাইল স্প্রীং, এনভিল, ব্যান্ড-স, চিজেল, পাঞ্চ, শেয়ার ব্লেড, ট্যাপ, ভাই, মিলিং কাটার, লেদের কাটিং টুল, রিমার, ফাইল, কোদাল, রেইল, পিয়ানোর তার, রেঞ্চ, রেজর প্রভৃতি নানা জিনিস তৈরি হয়।


টুল স্টিল (Tool steel) এর ব্যবহার

সচরাচর এটি খুবই শক্ত এবং ঘর্ষণ ও ক্ষয় প্রতিরোধী হয় বিধায় বিশেষত টুলস তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। যেমন কাটিং টুল, টুল বিট, মিলিং কাটার ইত্যাদি তৈরি করার কাজে ব্যবহৃত হয়।

এ্যালয় স্টিল (Alloy steel) কাকে বলে?

 কার্বন স্টিলের সাথে এক বা একাধিক ধাতু মিশ্রিত করে তৈরি স্টিলকে এ্যালয় 'স্টিল' বলে। কার্বন স্টিলের চেয়েও অধিক গুণসম্পন্ন স্টিলের প্রয়োজনের ক্ষেত্রে অ্যালয় স্টিল তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে যে ধাতু মিশ্রিত করে অ্যালয় স্টিল তৈরি করা হয় তার নামানুসারে অ্যালয় স্টিল নামকরণ করা হয়। যেমন যখন কার্বন স্টিলের সাথে নিকেল মিশ্রিত করে অ্যালয় স্টিল উৎপাদন করা হয়, তখন উক্ত স্টিলকে নিকেল স্টিল বলে। এছাড়া যদি অতিরিক্ত দু'টি ধাতু যেমন নিকেল ও ক্রোমিয়াম মিশ্রত করে যে অ্যালয় স্টিল পাওয়া যায় তাকে নাইক্রোম স্টিল বা নিকেল ক্রোমিয়াম স্টিল বলে। 

সংকর ইস্পাতের প্রকারভেদ 

(ক) স্টেইনলেস স্টিল (Stainless Steel) কার্বন স্টিলের সাথে ৪% হতে ২২% ক্রোমিয়াম এবং অল্প পরিমাণ নিকেল মিশ্রণে যে স্টিল পাওয়া যায় তাকে স্টেনলেস স্টিল (Stainless Steel) বলে। এই স্টিলের ক্ষয়রোধ শক্তি এবং মরিচা প্রতিরোধ ক্ষমতা এতই বেশি যে, দীর্ঘদিন ব্যবহারের পরেও এতে মরিচা কিংবা ক্ষয় হওয়ার কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। এজন্য এর ব্যবহারও খুব বেশি। গৃহস্থলির বাসনপত্র, চামচ, ছুরি, ঘড়ির কেস, ডাক্তারি সরঞ্জাম, রাসায়নিক সরঞ্জাম ইত্যাদি এই স্টিল দ্বারা তৈরি হয়।


(খ) টাংস্টেন স্টিল (Tumgsten steel): এই স্টিল খুবই শক্ত এবং সহজে স্থায়ী চুম্বকে রূপান্তর লাভ করে। এছাড়া একে তারে (Wire) ও পরিণত করা যায়। টাংস্টেন স্টিল দ্বারা ইলেকট্রিক বাতির ভিতরকার ফিলামেন্ট, চুম্বক, মেশিনের কাটিং টুল ইত্যাদি তৈরি করা যায়।


(গ) নিকেল স্টিল (Nickel Steel): নিকেল স্টিল খুবই শক্তিসম্পন্ন এবং আঘাত সহিষ্ণুতা স্টিল। এতে সাধারণত শতকরা ৫ ভাগ নিকেল এবং ০.১ ভাগ হতে ০.৪ ভাগ কার্বন বিদ্যমান থাকে। এর দ্বারা থার্মাল প্লেট, জাহাজের শ্যাফট, পিস্টন রড, কানেটিং রড, সাইকেলের ফ্রেম এবং স্পোক, ওয়্যার রোপ ইত্যাদি তৈরি করা হয়।


(ঘ) ক্রোমিয়াম স্টিল (Chromium steel): এটি নিকেল স্টিল থেকে অধিকতর শক্তিসম্পন্ন এবং ক্ষয় প্রতিরোধী। ক্রোমিয়াম স্টিলের ঘর্ষণজনিত ক্ষয় রোধের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ক্রোমিয়াম স্টিলের দ্বারা বলপেনের নিব, বল বিয়ারিং, ব্লেড, রোলার ইত্যাদি তৈরি করা হয়।


(ঙ) নিকেল-ক্রোমিয়াম স্টিল (Nickel-chromium steel): একে নাইক্রোম (Nichrom) স্টিলও বলা হয়ে থাকে। এর শক্তি ও সামর্থ্য ক্রোমিয়াম স্টিল থেকে অধিকতর। বিশেষ করে অতি উচ্চ তাপ কিংবা চাপে এর গুণাগুণ অক্ষুন্ন থাকে বিধায় উচ্চ তাপ কিংবা চাপযুক্ত ক্ষেত্রে এর ব্যবহার দেখা যায়। মোটরগাড়ি এবং অ্যারোপ্লেনের এক্সেল (axell), কানেকটিং রড (Connecting Rod), ক্র্যাংক শ্যাফ্ট, উচ্চ শ্রেণির গীয়ার ইত্যাদি তৈরিতে যথেষ্ট ব্যবহৃত হয়। এছাড়া নিকেল ক্রোমিয়াম স্টিল এর তৈরি তার (Wire) হিটারের কয়েল রূপেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।


(চ) ম্যাঙ্গানিজ স্টিল (Manganese Steel): ম্যাঙ্গানিজ স্টিল খুবই শক্ত এবং দীর্ঘস্থায়ী। এই স্টিলে শতকরা ১৫ ভাগ হতে ২২ ভাগ পর্যন্ত ম্যাঙ্গানিজ ব্যবহার করা হয়। একে চুম্বকে পরিণত করা যায় না। এর দ্বারা সাধারণত স্পিন্ডেল শ্যাফ্ট, কানেকটিং রড, সিন্দুক, পিস্টন রিং, পুশ রড ইত্যাদি তৈরি করা হয়। বিশেষ করে অধিক দুশ্চেদ্রতা গুণসম্পন্ন বিধায় কয়লা, ইট ও পাথর, ভাঙ্গার ক্রাশারের 'জ্যা' এবং রোলার তৈরিতে এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

(ছ) হাইস্পিড স্টিল (High speed steel): হাইস্পিড স্টিল খুবই শক্ত এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টুল স্টিল। এতে শতকরা ১৪ ভাগ থেকে ২২ ভাগ পর্যন্ত টাংস্টেন থাকে। সাধারণ মানের হাইস্পিড স্টিলে শতকরা ১৮ ভাগ টাংস্টেন, ৪ ভাগ ক্রোমিয়াম, ১ ভাগ ভেনাডিয়াম, কার্বন এবং অবশিষ্ট ভাগ লোহা থাকে। একে ১৮-৪-১ স্টিলও বলা হয়।ধাতু কাটার জন্য যে বাটালি বা কাটিং টুল ব্যবহার করে থাকি তা হাইস্পিড স্টিল-এর হলে খুব দ্রুত এবং সহজ উপায়ে ধাতু কাটা যায়। অন্যথায় কাটিং বিট এর মাথা ঘর্ষণজনিত তাপে সহজেই গরম হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু হাইস্পিড স্টিলের কাটিং টুল গরমে লাল হলেও কাটার ক্ষমতা নষ্ট হয় না।

হাইস্পিড স্টিল-এর দ্বারা ডাক্তারি যন্ত্রপাতি, লেদ, শেপিং, মিলিং মেশিনের কাটিং টুল, ড্রিল বিট, ট্যাপ, ডাই (dic) ইত্যাদি তৈরি হয়।


(জ) সিলিকন স্টিল (Silicon steel): সিলিকন স্টিল জেনারেটর ও ট্রান্সফরমার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।


(ঝ) মলিবডেনাম স্টিল (Molebdenum steel): এই স্টিলের টানা শক্তি প্রবল। সাধারণত অটোমোবাইল পার্টস এবং বিমানের কাঠামো তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।


স্টিল  কিভাবে চিনবেন?


মাইন্ড স্টিল চেনার উপায় 

 এর আবরণ মসৃণ এবং মরিচাহীন অবস্থায় নীলাভ দেখায়। মরিচা পড়লে একে লালচে বাদামি দেখায়।


মিডিয়াম কার্বন স্টিল চেনার উপায় 

এটির আবরণ মসৃণ এবং মরিচাহীন অবস্থায় নীলাভ কৃষ্ণবর্ণ দেখায়, মরিচা পড়লে এটিকে লালচে বাদামি দেখায়।


 হাইকার্বন স্টিল চেনার উপায় 

 এটির আবরণ মসৃণ এবং মরিচাহীন অবস্থায় গাড়-নীলাভ-কৃষ্ণবর্ণ দেখায়। মরিচা পড়লে এটিকে লালচে বাদামি দেখায়।


স্ফুলিঙ্গ দৃশ্য (Spark picture) চেনার উপায় 

 স্ফুলিঙ্গ দৃশ্য দ্বারা লৌহ ও বিভিন্ন ইস্পাতের ধাতুর খণ্ডকে গ্রাইন্ডিং হুইলের উপর নির্গত স্ফুলিঙ্গ দৃশ্যের যে রূপ হয় তাতে কোনো ধরনের লৌহ ও ইস্পাত বুঝা যায়। গ্রাইন্ডিং চাকাতে শান বা ঘর্ষণ করার সময় ধাতুর কণাগুলো অত্যন্ত উত্তপ্ত অবস্থায় বিক্ষিপ্ত হতে থাকে। অধিক কার্বন বিশিষ্ট স্টিলের বেলায় রশ্মির সংখ্যা বেশি হয় এবং স্ফুলিঙ্গগুলি উজ্জ্বল শ্বেতবর্ণের আলোক বিস্তার কারে কার্বন যত কম হবে আলোর রশ্মি ও স্ফুলিঙ্গ, বর্ণ তত কম হবে। রশ্মির সংখ্যা অতি কম প্রায় তিন-চারটে হয়।



Previous Post Next Post