মানুষের অপরাধ 


আইনের চোখে যা অপরাধ রাষ্ট্রের চোখেও তা অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়।সমাজে অপরাধের ধরণ ভিন্ন। অনেকে আইন পড়ে না।সংবিধানে যা লেখা আছে তা জানে না।বিষয়গুলো না জানলেও আমাদের তৃতীয় নয়ন অর্থাৎ মন বলে দিতে কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়?ধর্মে উল্লেখ আছে আদম হাওয়াকে খোদার কথা অমান্য করার অপরাধে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়া।আমরা যতদূর মানব সভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে অবগত আছি তাতে এটা স্পষ্ট যে পৃথিবী কখনো পাপ মুক্ত ছিলনা।পৃথিবীতে কখনো শান্তি ছিল না।কিন্তু কেন?কেন মানুষ আইন করে?আবার কেন মানুষ নিজের তৈর আইন ভঙ্গ করে।এটা শয়তানের কাজ? নাকি মানুষের লোভ ও বোধহীনতা এর জন্য দায়ী?

মর্গ্যান ফ্রিম্যান একবার এক ডকুমেন্টারিতে দুজন অপরাধীর সাক্ষাৎকার তুলে ধরেছিলেন।

প্রথম জন এক হাই সিকিউরিটি কারাগারের বন্দী।যে কিনা ২৪ টার বেশি ধর্ষণ ও তিনটা হত্যার আসামি। মর্গান তাকে প্রশ্ন করে আপনি কত বছর বয়স থেকে অপরাধ করেন? আসামি বলেন, ২২ কি ২৩ বছর বয়সে।কেন অপরাধ করেন এমন প্রশ্নের জবাবে আসামি বলে,তিনি অপরাধ করার জন্য পূর্ব পরিকল্পনা করেন না।হঠাৎ তার মাথায় আসে এটা করতে হবে তাই করেন। 

মর্গান তাকে আবারও জিজ্ঞেস করেন, এই অপরাধগুলোর জন্য আপনার কি খারাপ লাগে না?
আসামি বলেন,না ।অন্যদের মত তার অনুভূতি ও আবেগ কম।

দ্বিতীয় জন
মর্গান ফ্রিম্যান লস এঞ্জেলস এর এমন একজন মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন Doest Evil exist?  ডকুমেন্টারিতে যে কিনা একসময় অপরাধী ছিল।লোকটি বলেন কম বয়সে কিছু অপরাধী চক্রের গ্রুপে ঢুকে পড়েন।আপরাধ করতে থাকেন। একসময় একটি মেয়ের প্রেমে পড়েন।বিয়ে করেন।তার স্ত্রী যখন প্রেগন্যান্ট তখন তার মানুষিকতার পরিবর্তন আসে।সে ভাবতে থাকে তার মেয়েকে বড় করতে হবে।তার মধ্যে স্ত্রী সন্তানের প্রতি ইমোশন তৈরি হয়।যার কারণে অপরাধ ছেড়ে ভালো পথে ফিরে আসে।
আমরা উপরের  দুটি ঘটনা থেকে বুঝতে পারি অপরাধী জানে সে অপরাধ করছে তবুও সে অপরাধ করে কারণ তার মধ্যে ফিলিংস ও ইমোশন থাকে না।যখন আবেগ তৈরি হয়, যখন বোধ তৈরি হয় তখন সে অপরাধ ছেড়ে ভালো পথে ফিরে আসে।আমার ধারণা যারা অনেক বেশি সামাজিক, মানুষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে,মাদকাসক্ত নয়,নিজ পরিবারকে ভালোবাসে।নিজের ভবিষ্যৎ ও মৃত্যু নিয়ে ভাবে তাদের মধ্যে ইমোশন তৈরি হয়।তারা কখনো অপরাধ করতে পারে না।আর করলেও হয়ত ছোট কোন অপরাধ।এটা খুবই আফসোসের ব্যাপার যে পৃথিবীতে কখনো শান্তি ছিল না।

অপরাধ প্রবণতা কি মস্তিষ্কের উপর নির্ভর করে?

এব্যপারে রয়েছে বিতর্ক। তবে মর্গান ফ্রিম্যান এর নেয়া সাক্ষাৎকারের  প্রথম অপরাধীর মস্তিষ্ক স্ট্যান্ডার্ড এমআরআই স্ক্যান দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে লোকটি একজন সাইকোপ্যাথিক।তার মস্তিষ্কের বিশেষ একটি এরিয়া অন্যদের থেকে আলাদা যা কিনা মানুষের আচার আচরণ ও আবেগ তৈরি করে।এমন লোক নাকি প্রতি দশ লক্ষে একজন পাওয়া যায়।তবে কি তার অপরাধের জন্য তার মস্তিষ্ক দায়ী?যদি তাই হয় তবে অপরাধ করে অনেকে অনুতপ্ত হয়ে ভালো পথে ফিরে আসে কেন?



ধর্মে বিশ্বাস থাকার পরও কেন মানুষ অন্যায় করে?

ভালো জ্ঞান দেয়ার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য সমাজ সংস্কারক ও মহামানব পৃথিবীতে এসেছেন। অনেকে গ্রহণ করেছে অনেকে করেনি।

ভাব-ভাষা, নাম,বিশ্বাস আমরা মা-বাবার থেকে শিখে থাকি।সমাজ থেকে পায় নতুন নতুন শব্দ, বিশ্বাস আর কালচার।জন্মগতভাবে আমরা আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস পেয়ে থাকি।কিন্ত পূর্ণ ধর্মীয় জ্ঞান পায় না।ধর্মের বাইরেও মানুষের  কালচারাল উৎসব-ঐতিহ্য রয়েছে। সেগুলোও আমরা জন্মগতভাবে পেয়ে থাকি।নতুন নতুন বিশ্বাস  এবং সাংস্কৃতি অতীতের বিশ্বাস এবং সাংস্কৃতির পরিমার্জন, পরিবর্ধন এককথায় বিকৃতি থেকে পেয়ে থাকি।আমাদের পূর্বপুরুষরা যে উৎসব করত আমরা সেই একই উৎসব ভিন্নভাবে করছি।কেন আমাদের  সাস্কৃতির  বিকৃতি ঘটে কিন্তু বিলুপ্ত হয় না?   কেন আমরা ধর্মে বিশ্বাস করি কিন্তু পালন করি না?কারন আমরা দুনিয়া ও আখিরাত দুটোই চায়।যখন মৃত্যুর ভয় আসে, বিপদ আসে,অভাব ও রোগ আসে তখন ধার্মিক হয়ে যায়,মৃত্যুর ভয় কেটে গেলে ধর্ম মগজ থেকে সরে যায়।

 ধর্মে বিশ্বাস করেও কেন আমরা অন্যায় করি?
নামায পড়ে কপালে দাগ ফেলেছে অথচ ঘুষ খায়,গালি দেয়, মিথ্যা বলে।কেন এমনটা হয়? তাহলে নামায কি অর্থহীন।ধর্ম যদি অর্থহীন হয় তবে অর্থযুক্ত কোনটা? কোন কিছুতেই তো অন্যায়-অপরাধ নিশ্চিহ্ন করা যাচ্ছে না।আসলে নামায, রোযা,হজ্ব, যাকাত কিছু কিছু মানুষের কাছে শুধুমাত্র অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এগুলো করতে হবে তাই করে।কিন্তু এগুলো কেন করছি, এগুলোর গুরুত্ব কতটুকু তা তারা বুঝতে পারে না। ধর্ম শুধু বিশ্বাসের ব্যপার না।যারা ধর্মকে শুধু বিশ্বাসের মধ্যে রাখে তারা ধর্মে বিশ্বাস করেও অন্যায় করে।আবার ধর্ম শুধু প্র্যাকটিস বা অনুশীলনের ব্যাপার  না।যারা গুরুত্ব  না বুঝে, বা বিবেক দিয়ে চিন্তা না করে পথ চলে তারা নামায পড়েও অন্যায় করে।ধর্ম বিশ্বাস,অনুশীলন, উপলব্ধি, অনুধাবন, বিচার-বিশ্লেষন,বিবেক দিয়ে চিন্তা করার জিনিস। যারা এগুলো করে না তারা ধর্ম বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারে না।প্রতারণা করলে সৃষ্টিকর্তা শাস্তি দেবে এটা জেনেও কেন প্রতারণা করি? আসলে লোভ,দরকারবাদী মনোভাব, মনের উপর নিয়ন্ত্রণহীনতা, পরিবেশ একটি অদৃশ্য শক্তিশালী বলয় তৈরি করে।এই বলয় মানুষের বোধকে নিস্ক্রিয় না করতে পারলেও কিছু সময়ের জন্য বিবেক, মায়া-ভালবাসা,অনুভূতিকে ছাইচাপা দিয়ে রাখে।যখনই মানুষ এই অদৃশ্য বলয় থেকে বের হয়ে আসে তখন সে বুঝতে পারে অতীতের কাজগুলো করা উচিত হয় নি তার।অতীতের ভুল কাজের জন্য সে অনুতপ্ত হতে থাকে।মানুষ তার শেষ বয়স অর্থাৎ বৃদ্ধকালে বুঝতে পারে অতীতের কাজগুলো ভুল ছিল।তখন শেষ বয়সে এসে ধার্মিক বনে যায়।
কিশোর বয়সে বন্ধু বা খেলার সাথীর সংখ্যা থাকে বেশি।খেলতে খেলতে কেটে যায় সারাদিন। যুবক বয়সে, বন্ধু-বান্ধবের সাথে যুক্ত হয় প্রেম-আবেগ, চাকরি,কাজ-কর্ম, এরপর শুরু হয় বিবাহিত জীবন,সন্তান-সন্তুতি। অর্থ উপার্জন, অভাব-অনটন,কারর কারর জন্য মোহ-ফূর্তি,বিলাসিতা।এসব ব্যস্ততা মানুষের ন্যায়-অন্যায় বোধ সুপ্ত করে রাখে।এতোটা ব্যাস্ত রাখে যে  নিজেকে নিয়ে একান্তে-নির্জনে দশ মিনিট ভাবার সুযোগ দিতে চায় না।শেষ বয়সে এটার ঠিক উল্টোটা দেখা যায়।কারণ কাজ কমে যায়,শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে,ব্যাস্ততা কমে যায়,যৌন আকাঙ্ক্ষা লোপ পায়,মানুষ নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় পায়।মৃত্যু ভয় চারিদিকে ঘিরে ধরে।তৈরি হয় ভয়ের বলয়।আর একারণে শেষ বয়সে লোকে ধার্মিক হয়ে যায়।আযানের আগেই মসজিদে চলে যায়।হাতে থাকে তসবিহ। 


তাহলে আমাদের কী করা উচিত? 


ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশীলনের সাথে সাথে প্রতিটা কাজ করার পূর্বে নিজের বিবেককে প্রশ্ন করা উচিত। আপনি একজন বৃদ্ধকে চড় দিলেন এটা যদি আপনার বাবার সাথেও ঘটে।আপনার চেয়ে ক্ষমতাবান কেউ আপনার বাবাকে থাপ্পড় দেয় তখন আপনার কেমন লাগবে।আপনি ঘুষ খান, কখনো ভেবেছেন এই অর্থ-কড়ি কতদিন ভোগ করতে পারবেন?  মৃত্যু আর কতদিন বাকী? যারা এগুলো ভাবে।যারা বিবেককে প্রশ্ন করে তারা কখনো অন্যায় করতে পারে না।আমাদেরকে ভাবতে হবে।অনুভূতি জাগাতে হবে। মানুষের প্রতি আবেগ তৈরি করতে হবে।সন্তানদের জন্ম দিয়ে ছেড়ে দেয়া যাবে না।তাদেরকে সামাজিক জ্ঞান দান করতে হবে।সর্বদা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।সামজিক উন্নয়নমূলক কাজ করতে হবে।নিজেকে ভালো কাজে ব্যাস্ত রাখতে হবে।


Previous Post Next Post